Dracula sir-
দেবালয় ভট্টাচার্য্যের পরিচালনায় ড্রাকুলা স্যার প্রায় সবারই দেখা হয়ে গেছে। আজ ফিরে দেখি অন্য ঘরানার এই সিনেমাটি।
1971 এর কলকাতা, নকশাল আন্দোলন বন্ধুকের আওয়াজ গুলিগালা, একটা অশান্ত পরিবেশ থেকে আজকের স্বাভাবিক বাংলা, রক্তিম (অনির্বাণ ভট্টাচার্য্য) রাতের খাবারের জন্য ডিমের ওমলেট ভাজছে। তার বাড়িওয়ালা তাকে ডেকে পাঠায় ছেলেকে ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানোর জন্য। রক্তিম একজন অস্থায়ী প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক যার সামনের 2 টি দাঁত বড়ো, যে জন্য তাকে ড্রাকুলা বলে সবাই রাগায়। পুরো বাড়ি ভাড়া সে সময়ে দিতে পারে না তাই তাকে মাঝেমাঝে বাড়িওয়ালার ছেলেকে ভয় দেখিয়ে আসতে হয়।

রক্তিম কথা বলার সময় রুমাল দিয়ে বারবার মুখ ঢেকে নেয়, সে অস্বস্তি বোধ করে। স্কুলের বাচ্চারা মজা করে ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে রাখে ড্রাকুলা স্যার (Dracula sir)“। রক্তিম নিজেকে নকশাল আন্দোলনের একজন আন্দোলনকারী অমল সোম হিসেবে দেখতে থাকে এবং নিজের রাবীন্দ্রিক প্রেমিকা মঞ্জরী (মিমি চক্রবর্তী)। “পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমের চিঠিগুলো রনাঙ্গন থেকেই লেখা হয়েছে জানতো মঞ্জরী।” – থেকে একটা ৭০ এর দশকের ট্র্যাক চলেছে পেছনে যেটা বোঝাতে বারবার বলান হয়েছে “৭০ এর দশক হোক মুক্তির দশক” বা নবারুন ভট্টাচার্য্যের কবিতা
‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এ বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না।’
বারবার এই ট্র্যাক ঘুরে ফিরে আসায় এক ঘেঁয়ে লাগতে পারে, কিন্তু এই এক ঘেঁয়ে ট্র্যাক পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য্য পরে পরিষ্কার করেছেন।
বাড়ির মালিক তার বউয়ের (বিদিপ্তা চক্রবর্তী) ওপর অত্যাচার করলে রক্তিম (অনির্বাণ ভট্টাচার্য্য) মালিককে কামড়ে দিয়ে তাকে রক্ষা করে, ওন্য ট্র্যাকে মঞ্জরী (মিমি চক্রবর্তী) কাতু, লোকাল গুণ্ডার থেকে বাঁচতে তার পায়ে গুলি করে। মঞ্জরী রক্তিমকে বলে আগের জন্মে তার কাছে অস্ত্র ছিলো এবার আছে 2 টো দাঁত, এগুলোই তার হাতিয়ার।

তাহলে মঞ্জরী কি রক্তিমের পূর্বজন্মের প্রেমিকা? নাকি কোনো অশরীরি আত্মা নাকি মনের ভুল? রক্তিমকে ডাক্তার বুঝিয়ে বলে এই ঘটনা গুলো সে নিজেই মনে মনে সাজিয়ে নিয়েছে যেটা একটা রোগ, সিজোফ্রেনিয়া। আত্মবিশ্বাসের অভাব, নিরাপত্তাহীনতা ভয়, একাকীত্ব, ডিপ্রেশন থেকে তৈরি হয় মানসিক বিকৃতি, যা আজকের দিনে বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে কম বেশি বর্তমান। আধুনিক যুগের জীবনযাপনে ডিপ্রেশন মানুষের নিত্যসঙ্গী, আর অধিক চাপ থেকে নিজেকে নিজের মতো করে একটা কল্পিত জগতের মধ্যে আবদ্ধ করে নেয়।
রক্তিমও তাই করেছে নিজের 2 টি দাঁতের জন্য সবার থেকে আলাদা হতে হতে নিজের একটা জগত তৈরি করে নিয়েছে। তার পড়া ৭০ এর দশকের ইতিহাস ও বইগুলি রক্তিমকে অ্যাসাইলামে নিয়ে যাওয়ার পর বাড়িওয়ালী (বিদিপ্তা চক্রবর্তী) তার জিনিস পত্র বিক্রির সময় দেখে। অমল সোম, যার বেদীর সামনে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ অমল সোম নিজেই ওই বানানো ইতিহাস রক্তিমকে বলেছে। দাঁত 2টো যে তার কাছে কোনো একটা কারণে আছে সেটা দাঁত তুলতে গেলে ডাক্তার তাকে বলে।
তাহলে তো সব কিছুই মিলে গেলো একরকম কিন্তু শেষে, সুস্থ হওয়ার পর বেরোনোর পর এক রাত্রে গিয়ে রক্তিম দাঁড়ায় এক বাড়ির সামনে যেখানে সে নিজেকে মঞ্জরীর স্বামী হিসেবে একটা ছবিতে দেখতে পায়, গয়নায় সজ্জিত মঞ্জরীকে দেখে ঠিক পেছনেই। স্বাভাবিকভাবেই দর্শক আবার পুনর্জন্মের ধারণায় ফিরে যায়, কেউ কেউ বলে ভৌতিক আবার কেউ বলে পুরোটাই মানসিক স্থিতি।

ভৌতিক ধারণাটি আমার খুব একটা প্রিয় নয়। এবার যদি এটা সত্যি পুনর্জন্ম হতো তবে সেটা অমল সোম হিসেবে হতো, কারণ যা কিছু পুরো সিনেমা তে পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য্য দেখিয়েছেন তা রক্তিমের অমল হিসেবে দেখানো। কিন্তু পরে জানা যাচ্ছে অমল তো নিজেই বেঁচে আছেন। সুতরাং যদি পুনর্জন্ম হয় তবে তা মঞ্জরীর স্বামীর, কিন্তু যা ঘটনা দেখানো হয়েছে সেখানে তিনি মৃত। সুতরাং এই সব ঘটনা তার স্মৃতিতে থাকার কথা নয়। আমি মনে করি ওই ছবিটিও রক্তিমের কল্পনা, রক্তিম এখনও পুরোপুরি সুস্থ নয়। অমলের গল্পটা সত্যি নয় সেটা জানার পর রক্তিম আবার একটা গল্প সাজানোর চেষ্টা করছে মঞ্জরীকে মাঝে রেখে।
পুরো ৭০ এর দশকটাই তো রক্তিমের ভাবনা দিয়ে দেখা, রক্তিমের পড়া বা সবাইর ওপর ভিত্তি করে, সেই জন্যেই বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙ্গার দৃশ্যটি আছে, যা রক্তিম দেখেছে কিন্তু এরকম কিছু সত্যি কি ৭০ এর দশকে হয়েছিল? আমরা কেউ জানি না। রক্তিমের পড়া কবিতার হয়তো ওই কটা লাইন মনে আছে তাই এগুলি ঘুরে ফিরে বলে চলেছে, বা ৭০ এর দশকের 2/১ টি স্লোগান যা হয়তো রক্তিম পড়েছে, কল্পনা করেছে। বারবার একই শব্দ ব্যবহার রক্তিমের monotony কে তুলে ধরে।
সিনেমাটি আরো অনেক বেশি open ended হতে পারত বা আরো বেশি সাসপেন্স থাকলে দেখতে ভালো লাগতো তবুও বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে এই ধরণের কাজ নতুন, আশা করি সামনে আরো ভালো psychological কাজ দেখতে পাবো।