ঘরে বাইরে আজ(Ghore baire aaj) –
আর্ট সমাজের দর্পন, সিনেমার মতো এতো বড়ো একটা মাধ্যম আজকের সমাজের কথা বলবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু যদি কোনো সিনেমা পলিটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখানো হয়? তাহলে কি সেন্সরের খাঁড়া নেমে আসবে? আটকে যাবে? যেতেই পারে, কিন্তু তা বলে তো বলা বন্ধ করে দিলে হয় না। আচ্ছা যদি আমার এই পলিটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি ভালো না লাগে, যদি আমার মতের সাথে না মেলে তবে? তবে ক্ষতি তো নেই সিনেমা দেখব শুধু সিনেমা দেখার জন্যেই।
ঘরে বাইরে আজ(Ghore baire aaj) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পলিটিক্যাল উপন্যাস ঘরে বাইরে থেকে নেওয়া, যাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই দুটো দিক দেখাচ্ছেন, একদিকে যারা স্বদেশীর পক্ষে তাদের ভাবনা, তাদের পক্ষে যুক্তি অন্যদিকে যারা স্বদেশী সমর্থন করে না তাদের পক্ষের যুক্তি। এই উপন্যাসকে কেন্দ্র করে সত্যজিৎ রায় তৈরি করেছিলেন ঘরে বাইরে, যা একটা ক্লাসিক হয়ে রয়ে গেছে। ঘরে বাইরে আজ(Ghore baire aaj) একটা অ্যাডাপটেশন মাত্র, কেউ কেউ বলবে রিমেক। কিন্তু এই অ্যাডাপটেশন শব্দটি কতোটা শক্তিশালী? এতে পরিচালকের কাছে কতোটা স্বাধীনতা থাকে প্লট নিয়ে কাটাছেঁড়া করার?

আমার মতে উপন্যাসভিত্তিক সিনেমা আর অ্যাডাপটেশন আলাদা। অ্যাডাপটেশন করতে চাইলে কখনো থিম কখনো চরিত্র কখনো শুধুই ধারণার ওপর সিনেমা বানানো যায়, সেই স্বাধীনতাতেই নতুন করে স্ক্রিন প্লে লেখা যায়। সত্যজিৎ রায় উপন্যাসের একটা চিত্ররূপ দিয়েছিলেন, যেখানে নাটকীয় পরিবর্তন ছাড়া বেশি পরিবর্তন তিনি করেননি। অপর্ণা সেনের ঘরে বাইরে আজ শুধু চরিত্রের রসায়নটুকু রবি ঠাকুরের থেকে ধার নিয়েছে, এবং তাকে নিয়ে এসে ফেলেছে আজকের পলিটিক্যাল দোলাচলে।
সেই সময়ের স্বদেশী পণ্য ও সস্তা পণ্যের মধ্যে কোনটা ব্যবহার করা যায় তার তর্ক আজকের ধর্ম না খাদ্যের তর্কে এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে একটা দিক কিন্তু এক, দারিদ্র্যের লড়াই। নিখিলেশ মনে করে দারিদ্র্যের জীবনে ধর্মের স্থান নেই। আর সন্দীপ ঝা মনে করেন সনাতন ধর্মের রক্ষা করা খুব প্রয়োজন। এই নিয়ে দুই বন্ধুর মতপার্থক্য।
কিন্তু রবি ঠাকুর আর সত্যজিৎ রায়ের গল্পে বিমলা ছিল বাড়ির বউ যে নিখিলকে ছাড়া কোনো পুরুষকে চেনে না। এখানে বৃন্দা শিক্ষিত, চাকরি করে তাহলে তার ক্ষেত্রে সন্দীপকে দেখেই প্রেমে পড়ে যাওয়া দেখতে দর্শকের অবাক লাগবে। এখানেই অপর্ণা সেন খেলেছেন মনস্তত্ত্বের খেলা। কিছু কিছু মানুষের চরিত্র এমন হয় যে খুব সহজেই অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। সন্দীপ সেই রকম এক জন। যাকে দেখেই মেয়েরা খুব সহজেই আকর্ষণ অনুভব করে। অপর্ণা সেনের ভাষায় “মেয়েরা ধূপধাপ প্রেমে পড়ে”। কিন্তু তাও কি সব কিছু এত সহজে মেনে নেওয়া যায়?
ঘৃতাহুতি দিয়েছে বৃন্দার একাকীত্ব। নিখিলেশের বাইরে চলে যাওয়া, বৃন্দা-সন্দীপের একসাথে সময় কাটানো। নিখিলেশ জানে তার বিনি বাইরে খুব বেশি ঘুরে দেখার সুযোগ পায়নি, কখনো চায়ও নি হয়তো। তার কারণ সে বিহার থেকে আসা দলিত একটা মেয়ে, সবসময় নিজেকে এই সমাজের থেকে আলাদা করে দেখেছে, এটাই একটা কারণ বাইরে তার বন্ধু না থাকার। সন্দীপ তাকে বাইরের জগত দেখিয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় তারা ঘুরে বেরিয়েছে।
যেকোনো ছবিতে কাস্টিং খুব গুরুত্বপূর্ণ, অনির্বাণ ভট্টাচার্য্য এবং যীশু সেনগুপ্ত একদম perfect কাস্ট হলেও তুহিনা দাসকে ব্যবহার করে পরিচালক সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তুহিনা দাসের স্ক্রিন প্রেসেন্সের মধ্যে একটা আলাদা পরিচ্ছন্নভাব রেখেছেন যা খুব দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এছাড়া তার কথা বলার ধরণ এবং অভিনয় আলাদা মাত্রা দিয়েছে। অনির্বাণ বাঙালি চরিত্রে বেশ সাবলীল তাঁর মোটা চশমা পাইপ সব মিলিয়ে লুক দারুণ লেগেছে। কিন্তু অভিনয় আরো ভালো হতে পারতো, ব্যোমকেশের অনির্বাণের একটা ছাপ দেখা যায়। যীশু সেনগুপ্ত মানানসই, মাঝে মাঝে তার হিন্দি বলা যেনো জোর করে তার দিল্লীতে থাকা প্রমাণ করতে চায়।
আরো সময় দিলে হয়তো চরিত্রের মধ্যেকার রসায়ন আরো ভালোভাবে ফুটে উঠত, কিছু ক্ষেত্রে প্লটের দুর্বলতা দেখা যায়। সম্পর্কের টেনশন আরো অন্যভাবে দেখানো যেতো।
Bgm এর চড়া ব্যবহার নেই, খুব হালকা একটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সিনগুলিকে একসাথে ধরে রেখেছে, নীল দত্তের কাজ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। আর সিনেম্যাটোগ্রাফার সৌমিক হালদারের নাম আলাদা করে না বললেই নয়, তার কাজও বেশ ভালো।