‘পিকু(Piku)’:
যখন ফ্রান্সের ফ্রিল্যান্স প্রোডিউসার হেনরি ফ্রেস, সত্যজিৎ রায়কে অনুরোধ করেন ফ্রান্সের একটি টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য একটি ছবি বানাতে, তখন সত্যজিৎ রায় স্থির করেন তার রচিত ছোটগল্প ‘পিকুর(Piku) ডায়েরি’ অবলম্বনে একটি শর্টফিল্ম বানাবেন। এভাবেই আমরা পাই সত্যজিৎ রায়ের আর একটি অসাধারণ সৃষ্টি ‘পিকু(Piku)’। ২৫ মিনিটের এই শর্টফিল্ম 1980 সালে ফ্রান্স 3 চ্যানেলে প্রদর্শিত হয়। পরে অ্যাকাডেমি ফাউন্ডেশন এই সিনেমাটিকে সংরক্ষণ করে রাখার চেষ্টা করলে, প্রথমে ব্যর্থ হয়, অবশ্য পরে সাফল্য আসে। সিনেমায় অভিনয় করেছেন অপর্ণা সেন, ভিক্টর ব্যানার্জি, শোভন লাহিড়ী, প্রমোদ গাঙ্গুলি ও শিশুশিল্পী অর্জুন গুহ ঠাকুরতা। সত্যজিৎ রায়ের স্বরচিত গল্প পিকুর(Piku) ডায়েরি, একটি ছয় বছরের বাচ্চার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা তার পরিবারের কথা।
সে তার ভুল বানানের সাথে সরলতা মিশিয়ে তার পরিবারে ঘটতে থাকা ঘটনা গুলো এক এক করে জানাতে থাকে। তার ডায়েরির পাতা শেষ হওয়ার সাথে তার পরিবারের টুকরো হয়ে যাওয়া ছবিটাও আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। এই গল্প কে সিনেমার পর্দায় আনা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল বটেই। সিনেমায় রুপান্তরণে তিনি গল্পে কিছু পরিবর্তন করেন। সিনেমা শুরু হয় এক সাধারণ দিনের সাথে, যেখানে পিকুর বাবা তৈরি হচ্ছেন অফিসে যাওয়ার জন্য। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন, অপ্রত্যাশিতভাবে পিকুর(Piku) আজ স্কুল ছুটি, তাই সে ঘরেই থাকবে। প্রত্যুত্তরে পিকুর(Piku) বাবার শ্লেষাত্মক বক্তব্য থেকে জানতে পারি, তার স্ত্রী, অর্থাৎ পিকুর মা এই মুহূর্তে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িত। এরপরে গল্প ঘুরে যায় পিকুর দিকে, আমরা একদিনের জন্য পিকুর জীবনে প্রবেশ করি।
এখানে, লক্ষ্যনীয় সত্যজিৎ রায়ের শিশু মনের ছবি আঁকা, প্রত্যেক গল্পে শিশু চরিত্রদেরকে পরিপূর্ণ ভাবে ফুটিয়ে তোলা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। আমরা পিকুকে ছাদে বেড়াতে দেখি, যেখানে পাশের বাড়ি তে একটি কুকুর চিৎকার করছে।পিকুর(Piku) এক ধমকে কুকুরটি চিৎকার থামিয়ে দেয়। এরপর পিকু নিজের খেলার জগতে ঢুকে পড়ে। পিকু একা, খুব একা। তার বাবা নিজের কাজের মাঝে এতটাই ব্যস্ত যে স্ত্রী ও সন্তানের জন্য কোনো সময় খুঁজে পান না। আর তার মা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে থেকে অনেকটাই ছেলের প্রতি উদাসীন হয়ে উঠেছে। তার একমাত্র বন্ধু তার দাদু, যে দুবার হার্ট অ্যাটাকের পর এখন শয্যাশায়ী। তাকে গিয়ে সে জানায় যে গত রাত্রে সে বাবা আর মাকে ঝগড়া করতে শুনেছে।
যেখানে ইংরেজিতে তাদের কথার বেশি কিছু বুঝতে পারেনি, কিন্তু যখন ‘old man’ কথাটা বার বার শুনেছে, সে বুঝতে পেরেছে, তার এবং দাদুর দুজনের বিষয়েই ঝগড়া হয়েছে। এই কথা শুনে বৃদ্ধের মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে, সে বুঝতে পারে, এখন সে পরিবারের কাছে একটা বোঝার মত। পিকুর কাছে দারোয়ানের উবু হয়ে বসে ভাতের সাথে লঙ্কা খাওয়াও একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। সে নিতান্তই সরল, তাই যখন তার মায়ের প্রেমিক হিতেশ উপস্থিত হয় এবং তাকে রঙ্গীন কলম ও আঁকার খাতা উপহার দেয়, সে নিতান্তই খুশি হলেও, আমরা বুঝতেই পারি, এটা নিতান্তই হিতেশের দেওয়া উৎকোচ যাতে পিকু ওই নিয়ে সারা দুপুর মেতে থাকে। পিকু কে সরিয়ে রাখার জন্য তার মা তাকে উপদেশ দেয়, বাগানে গিয়ে ফুলের ছবি আঁকতে।
পিকু যখন বাগানে গিয়ে ছবি আঁকতে ব্যস্ত, সেই সময় তার দিকে চোখ রেখে জানলায় দাড়িয়ে থাকা তার মা কান্নায় ভেঙে পড়ে, সে নিজের বাসনা আর অনুশোচনার মধ্যে টানাপোড়েনের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়। এই জায়গায় আমরা পিকুর বাগানে প্রকৃতির সাথে একটা অতীব সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাই। বাগানের ছোট্ট সুন্দর প্রকৃতির মধ্যে পিকু হারিয়ে গিয়েছে।এই দৃশ্যের সবচেয়ে উপভোগ্য বিষয় হলো, সত্যজিৎ রায়ের নিজস্ব কম্পোজ করা এভারগ্রীন মিউজিক। একটি সাদা ফুল আঁকতে গিয়ে পিকু দ্বিধার মধ্যে পড়ে। সে চিৎকার করে মাকে ডাকে, যে সাদা ফুল কালো কালিতে আঁকা যায় কিনা। এমন সময় বৃষ্টি শুরু হওয়ায় সে বাড়িতে এসে দেখে বন্ধ ঘরের মধ্যে তখন কাকু আর তার মায়ের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়েছে।
এখানেও সে এক ধমক দেয়, এবং অপ্রত্যাশিত ভাবে ঝগড়া থেমে যায়। কিন্তু এরপরে দাদুর ঘরে গিয়ে দেখে, তিনি আর জীবিত নেই। তৃতীয় হার্ট অ্যাটাকে তার শরীর যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেছে। ভাঙ্গা মনে কাঁদতে কাঁদতে পিকু বাইরে আসে, ও ছবি আঁকতে থাকে, যেনো ছবি আঁকার মধ্যেই, ভাঙাচোরা দুঃখ কষ্টের এই জগৎটা থেকে পালিয়ে রঙ্গীন, হাসি খুশি একটি পৃথিবীতে চলে যায়। সত্যজিৎ রায়ের নিজস্ব মতামত অনুযায়ী ‘পিকু’ একটি অত্যন্ত জটিল মনস্তাত্বিক সিনেমা, যা একটি বাচ্চার সরল মন থেকে বড়দের ত্রুটিপূর্ণ জগৎটাকে বিচার করে। আমরাও যেনো বুঝতে পারি ছোটদের চোখে প্রাপ্তবয়স্কদের ক্রিয়াকলাপ কতটা অর্থহীন লাগে।