Kanchanjangha:
বছর বছর ধরে, বাঙালী জাতি নিজেদের কিছু বিশেষ ঐতিহ্য, কিছু বিশেষ কৃষ্টি তৈরি করেছে ও তাকে বজায় করে রেখেছে। বাঙালী কব্জি ডুবিয়ে খেতে ভালোবাসে, বৃষ্টির রাতে কি অলস দুপুরে ঘুমোতে ভালোবাসে, গল্পের বই পড়তে ভালোবাসে, আর? আর ঘুরতে যেতে ভালোবাসে। কল্পনায় সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করলেও, বাস্তবে কিন্তু আমাদের তিনটি জায়গা রয়েছে যেখানে আমাদের জীবনে অন্তত একবার ঘুরতে যাওয়া must। বাঙালির সেইরকম একটি প্রিয় জায়গাকে সাক্ষী রেখে সত্যজিৎ রায় ১৯৬২ সালে নির্মাণ করেন ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা( Kanchanjangha )’। কাঞ্চনজঙ্ঘা( Kanchanjangha ) সত্যজিৎ রায়ের প্রথম রঙ্গীন ছবি। তার কারণ কিন্তু সহজেই অনুমেয়। পুত্র সন্দীপ রায়ের মুখে আমরা শুনেছি দার্জিলিং ছিল মানিক বাবুর অন্যতম প্রিয় ভ্রমণের ঠিকানা।
মানিক বাবুর কথায় দার্জিলিংয়ের পরিবেশ, বিস্তৃত পর্বতমালা, শান্ত পাইন বন তাঁর কাছে ছিল স্বপ্নরাজ্যের মত। তাই এই জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য কে রঙের খেলায়, নিজের লেন্সে বন্দী করবেন এতো অত্যন্ত স্বাভাবিক। আর তাই দার্জিলিংয়ের ওপর নিজের প্রথম চিত্রনাট্য লিখে ফেললেন। কিন্তু শুধু মাত্র রঙ্গীন ফিল্মের এই একটি কিন্তু উদ্দেশ্য নয়। আসলে সিনেমার জগতে আপনি প্রবেশ করলে দেখতে পাবেন, দার্জিলিংয়ের আবহাওয়ার সাথে চরিত্রদের মানসিক অবস্থা, তাদের আচরণ, তাদের ব্যবহার ক্রমশঃ পরিবর্তন হচ্ছে। তাই বিভিন্ন সময়ের আলো, প্রকৃতিকে সঠিক ভাবে দেখানোর প্রয়োজন ছিল। দার্জিলিং যারা ভালবাসেন, তাদের জন্য এই সিনেমা ভিস্যুয়াল ট্রিট। ম্যাল, কেভেন্টার এর মত প্রিয় স্থানগুলিতে সত্যজিৎ বাবু শুটিং করেছেন। বিভিন্ন চরিত্রর শহরের বিভিন্ন জায়গায় আলাপচারিতার মাধ্যমে গল্প এগিয়েছে।
এখানে কথা আসতে পারে তাহলে সিনেমার নাম ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা(Kanchanjangha)’ রাখা হলো কেনো? দার্জিলিং ও তো রাখা যেতে পারতো। আসলে এখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা(Kanchanjangha) শুধুমাত্র আকর্ষণীয় দর্শনের বস্তু নয়, বরং প্রত্যেকের আত্মউন্মোচন এর প্রতীক। প্রত্যেকে নিজের জীবনের বাধা, দুর্বলতা, আড়ষ্টতা, ভ্রান্তি কে কাটিয়ে ওঠে আর নিজের পায়ে দাঁড়ায়। এই সিনেমা সেই সমস্ত চরিত্রদের কুয়াশা সরিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা (Kanchanjangha) খুঁজে পাওয়ার গল্প।

কলকাতা থেকে একটি পরিবার এসেছে দার্জিলিং বেড়াতে, পরিবারের কর্তা ইন্দ্রনাথ রয়। ছবি বিশ্বাসকে আমরা দেখতে পাই কড়া মেজাজের কর্তার চরিত্রে যিনি একাধারে আত্মকেন্দ্রিক, দাম্ভিক, রাশভারী মেজাজের, যিনি প্রচন্ডভাবে ব্রিটিশসংস্কৃতিপ্রিয়। পরিবারে সকলের ওপর তার কর্তৃত্ব চলে। তার আদেশের ওপরে অন্য কারোর কথা চলে না। তাঁর স্ত্রী লাবণ্য সারাজীবনই এই ব্যাপারে চুপ থেকেছেন। স্বামীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনোদিন মতামত দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই বড় মেয়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইন্দ্রনাথবাবুর পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে হয়, যার পরিণাম এই মুহূর্তে তাদের অসুখী সংসার। তাই যখন ইন্দ্রনাথ ছোটো মেয়ে মনীষারও বিয়ে নিজের পছন্দ মত দেবেন ঠিক করেন, লাবণ্য নিজের মনেই দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। ইন্দ্রনাথের কাছে সুপাত্রের সংজ্ঞা হলো বিদেশ ফেরত ও ভালো মাইনে। কিন্তু মনীষা যে মোটেই এরকম নয়।
সে সাহিত্য ভালোবাসে, ফুল ভালোবাসে, পাহাড়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসে। তাই সমস্যা গোড়াতেই। এই নিয়ে গোড়া থেকেই একটা দ্বন্দ্ব চলছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আপাত দৃষ্টিতে কিন্তু সবাই খুশি। আর পরিবেশও রৌদ্রোজ্জ্বল। মনীষার আলাপ হয় অশোকের সাথে যে কলকাতা থেকে এসেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে অর্থসমস্যায় পড়েছে। ইন্দ্রনাথ এর ছেলেকে টিউশনি পড়ানোর সুবাদে অশোকের মামা ইন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন অশোককে একটা চাকরি পাইয়ে দিতে। কিন্তু ইন্দ্রনাথ তাকে মনে রাখার প্রয়োজনও বোধ করেননি আর তাঁর অনুরোধকেও বিশেষ গুরুত্ব দেননি। বরং অশোককে ডেকে এনে তাকে নিজের কর্তৃত্ব জাহির করেন, ব্রিটিশ প্রীতির গল্প শোনান, এমনকি ভারতের স্বাধীনতায় বিপ্লবীদের অবদানকে খাটো করেন। সব শুনে অশোক নিজেকে স্থির রাখতে পারে না, আত্মমর্যাদার সাথে তাঁর চাকরি প্রত্যাখ্যান করে। ততক্ষণে কিন্তু দার্জিলিংয়ের আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে।

এই মেঘলা আবহাওয়াতেই এই পরিবারের সমস্যা গুলো এক এক করে আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। পরিবারের প্রত্যেকের জীবনে সমস্যা তৈরি হয়েছে, শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব মতামত প্রকাশ করতে না পারায়, আবার উল্টোদিকে আমরা বড়ছেলে অনিলকে দেখি, কেভেন্টারে বসে খোলা মনে একটি মেয়ের সাথে ফ্লার্ট করতে। একাধিক মেয়েকে একাধারে প্রেমের প্রস্তাবে তার কোনো লজ্জা নেই। সে অবলীলাক্রমে একটি মেয়েকে তার অতীত নিয়ে জিজ্ঞেস করে, তাকে অন্য পুরুষের সাথে আলাপ করতে দেখে সন্দেহ করে, আর তার প্রত্যাখ্যানে এক মুহুর্ত বিচলিত হয়ে পরক্ষণেই পাশে বসে থাকা একটি মেয়ের সাথে তোষামোদ শুরু করে। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় পরিবারে ছেলেদের জন্য ও মেয়েদের জন্য নিয়ম সম্পূর্ণ আলাদা।
মহিলাদের ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যর কথা ভাবা অন্যায়। কিন্তু এই জরাজীর্ণ ধারণা থেকেই পরিবারের মহিলারা এক এক করে বেরোতে থাকে। মণি তার হাবে ভাবে বুঝিয়ে দেয় পাত্রকে যে এই বিয়েতে তার মত নেই। বড় মেয়ে অনিমা নিজের মেয়ের খাতিরে স্বামীর সাথে তার সম্পর্ককে আবার নতুন এক সূচনা দেয়। ইন্দ্রনাথের স্ত্রী লাবণ্য শেষ পর্যন্ত নিজের মতামত খোলা মনে জানাবে বলে মনস্থির করে। এই সবের মধ্যে স্বয়ং ইন্দ্রনাথ রয় হয়তো বিভ্রান্ত, নিজের দোষ ত্রুটির কারনে এখনো তিনি আটক হয়ে আছেন। কিন্তু হঠাৎই তিনি দেখতে পেলেন সামনে অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘা( Kanchanjangha)। বোধহয় এই মুহুর্তেই তিনি তাঁর সমস্ত দোষগুলোকে পেরিয়ে আসেন। শুরু করেন নতুন এক যাত্রা। লক্ষ্য করা যায়, এই কাঞ্চনজঙ্ঘা( Kanchanjangha) সিনেমা কিন্তু হাল্কা মেজাজে তৈরি, যেখানে সমস্যা গুলো একটু হলেও সরল ও সমাধানযোগ্য। সেই সাথে সিনেমার ক্লাইম্যাক্স ও একটি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে আসে। তাই সব মিলিয়ে স্বকীয় ভাবে এই সিনেমা অনন্য স্থান গ্রহণ করে আছে।