Poroshpathor:
বাংলা সিনেমাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার হোতা সত্যজিৎ রায় কে নিয়ে কিছু বলাটা ধৃষ্টতা। তাঁর জন্মের ১০০ বছর পরেও, তিনি একই রকম ভাবে আমাদের মত সিনেমা প্রেমী দের মধ্যে রয়ে গিয়েছেন। নিজের কর্মজীবনে ৩৩ টি ছবির মধ্যে অনেক ছবিই অত্যাধিক ভাবে জনপ্রিয় ও সর্বজন পরিচিত। কিন্তু তার মাঝেই কিছু সিনেমা রয়ে গিয়েছে, যাদের নিয়ে কথা কম হয়। Meet Your Opinion এই মে মাসে সত্যজিৎ রায়ের সেই ধরনের কিছু সিনেমাকে নিয়ে বলবে। আজকের ছবি, পরশপাথর(Poroshpathor)।
সত্যজিৎ রায়ের প্রথম দিকের তৈরি একটি অন্যতম সিনেমা, যাকে নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে সেই কালে হইচই থাকলেও, আন্তর্জাতিক দরবারে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। কারণ এই ছবির গতি অপ্রত্যাশিত ভাবে বেশি ছিল, এবং এর আগে তাঁর তৈরি দুটি সর্বোৎকৃষ্ট রত্ন; পথের পাঁচালি ও অপরাজিত তে তিনি যে “Poetic realism” ধারা দেখিয়েছিলেন, তা এই সিনেমাতে মিসিং ছিল। আসলে, ‘পথের পাঁচালি’ ও ‘অপরাজিত’ বিশ্বজোড়া সমাদর পেলেও, বাণিজ্যিক ভাবে অসফল ছিল।
এই জন্য সত্যজিৎ রায় ঠিক করেন হয় পরের সিনেমা, তিনি নাচ, গান-বাজনার সাথে সাযুজ্য রেখে করবেন,বা সিনেমাতে হিউমার এর ব্যবহার করবেন। তিনি সেই সময় ছবি বিশ্বাস এর সাথে ‘জলসাঘর’ এর শুটিং শুরু করেন, এবং সেই সাথে লেখক পরশুরাম এর ছোট গল্প ‘পরশপাথর( Poroshpathor)’ এর ওপর নির্ভর করে চিত্রনাট্য লেখেন। শুটিং এর মাঝে যখন ছবি বিশ্বাস বার্লিন যান পুরস্কার গ্রহণ করতে, সেই সংক্ষিপ্ত সময়ে সত্যজিৎ রায় এই সিনেমার শুটিং করেন। এই ‘পরশপাথর( Poroshpathor)’ সিনেমা, তাঁর প্রথম হাল্কা মেজাজের মজার ছবি এবং সেই সাথে প্রথম ‘Magic realism’ নিয়ে তৈরী সিনেমা।
সত্যজিৎ রায়ের আইডল ফরাসি চিত্রপরিচালক জিন রেনওয়াঁ র প্রভাব এই ছবিতে লক্ষ্য করা যায়। এর সিনেমাটোগ্রাফির দায়িত্বে ছিলেন সুব্রত মিত্র, এডিটিং এ দুলাল দত্ত ও সংগীত পরিচালনা করেন রবিশঙ্কর। স্বাভাবিক কারণেই এই ছবিকে সবাই হাস্য কৌতুক ঘরানার বলবে, কিন্তু এই সিনেমা দেখে সাধারণত আপনার খিলখিলিয়ে হাসি বেরোবে না। বরং বলা যায় এই সামাজিক প্রহসন বা বিদ্রূপাত্মক গল্প, যেখানে কিছুটা দুঃখব্যঞ্জক অনুভূতিও রয়েছে। এক দিক দিয়ে বলা যায়, এই ‘পরশপাথর( Poroshpathor)’ ছবি একটি সামাজিক নীতিগল্প যেখানে একটা সমাজের সমস্ত খুঁত গুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে।
একটি রূপকথার পাথর যা দিয়ে কোনো ধাতুকে ছোঁয়ালে তা সোনায় রূপান্তরিত হয়, এই ধরনের ফ্যান্টাসির সাথে সেই যুগের কোনো ভারতীয় সিনেমার তুলনা করা যায়না। আর এ সমস্ত কিছুই সম্ভব হয়েছে সিনেমার অসাধারণ কাস্টিং এর জন্য। মুলচরিত্র পরেশ দত্তর ভূমিকায় তুলসী চক্রবর্তী, চাকর ব্রজহরির চরিত্রে জহর রায়, সেক্রেটারি প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাসের চরিত্রে কালী ব্যানার্জী ও পুলিশ অফিসারের চরিত্রে হরিধন মুখার্জী। যদিও স্ক্রীন প্রেজেন্স সবচেয়ে বেশি শুধুমাত্র তুলসী চক্রবর্তী ই পেয়েছেন।
তার অভিনয় ও এক্সপ্রেশন থেকে আমরা বুঝতে পারি, যদি তোমার কাছে অর্থ থাকে, তাহলে তোমার মেজাজেও একটা ঠুনকো ভারিক্কি চাল চলে আসে। তখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে আবোল তাবোল বকলেও, তোমার কথার তখন গুরুত্ব অনেক! তবে সিনেমার সবচেয়ে সেরা মুহূর্তগুলো তিন জায়গায়, যেখানে সত্যজিৎ রায় দীর্ঘ দৃশ্যের মাধ্যমে চারিত্রিক ও সামাজিক বিদ্রুপ ছুঁড়ে দিয়েছেন। প্রথম দৃশ্য, যখন পরেশ দত্ত ঘরের সমস্ত লোহার দ্রব্য সোনায় রূপান্তরিত করে দোকানে বেচতে যায়, এবং তারপর ভালো দাম পেয়ে আগে শখ পূরণ করতে প্রাইভেট ট্যাক্সিতে চড়ে। প্রথমে তো অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপারে তার মন ঈশ্বরের ভয়ে কাঁপছিলো, কিন্তু সোনা বিক্রির পরে প্রাপ্ত অর্থ দেখে তার মাথা ঘুরে গেছে।
এখানে পরিচালক আমাদের প্রত্যেকের মনের গোপন ইচ্ছেগুলোকে জাগিয়ে দিয়েছেন। আমরা প্রত্যেকেই কল্পনা করি, এক অলৌকিক ক্ষমতার যার বলে আমাদের পরিস্থিতি রাতারাতি পাল্টে যাবে। সেই ক্ষমতা হাতে পেয়ে পরেশ দত্ত নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে না, আর স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, সেও কোনো দিন জাতীয় নেতৃত্ব হয়ে উঠবে, সবার মত তারও প্রতিকৃতি স্থাপন হবে। এর পরেই আমরা চলে যাই সোজা এক পরিস্থিতিতে যেখানে পরেশ দত্ত একজন সম্ভ্রান্ত বিত্তশালী, এবং চারিদিকে বিস্তর দানধ্যান দেখে বোঝা যায়, তাদের মন কিন্তু এখনও উদার প্রকৃতির রয়েছে। পরেশবাবু এখন নেতা হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছেন। এদিকে স্ত্রী ননীবালা দত্ত কিন্তু বসে বসে দুঃখ করেন যে আগের বাড়ির প্রতিবেশীদের সাথে কথা হয়না! কিন্তু এমন সময় হয় ইন্দ্রপতন!
একটি সম্ভ্রান্ত ককটেল পার্টিতে আমন্ত্রিত হন পরেশ বাবু, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন সমাজের উচ্চবিত্ত সমাজে তিনি মোটেই অভ্যর্থিত নন।এখানে শুরু হয় দ্বিতীয় দীর্ঘ দৃশ্য যেখানে, উচ্চবিত্ত সমাজের আদব কায়দা, মিথ্যে ঠাট বাটে পরেশ দত্ত নিজেকে দলছাড়া পাচ্ছেন। কোনো দিন মদ্যপান করেননি, আর ককটেল তো দূরস্থান, তাই অনর্থক দার্শনিক আলোচনা, আর ভন্ড বুদ্ধিজীবী আলোচনার মাঝে নিজেকে একা পেয়ে কিছুটা দুঃখিত হন, কিন্তু তারপর নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে আত্মতৃপ্তিতে বুক ভরে ওঠে, এবং আকন্ঠ মদ্যপান করেন। নেশার ঘোরে সবার হাসির পাত্র হন, এবং তারপর অপমানিত হয়ে সবার সামনে নাটকীয় ভাবে পরশ পাথরের(Poroshpathor) কামাল দেখিয়ে আসেন।
সকাল বেলা নেশা ছুটলে বুঝতে পারেন, হাটে হাঁড়ি ভেঙে এসেছেন। এর পর শুরু হয় টানাটানি। এই জায়গাতে অর্থাৎ শেষ অর্ধে, সত্যজিৎ রায়, পরশুরামের গল্পের থেকে বাইরে বেরিয়ে একটি কল্পিত সামাজিক দৃশ্যকল্প রচনা করেছেন। যখন জানাজানি হয়েছে, এখন লোহা থেকে সোনা তৈরি হচ্ছে তখন সাধারণ মানুষের ধারণা হয়েছে যে সোনার মূল্য ক্রমশ পড়ে যাবে, এবং সোনা আর মূল্যবান থাকবেনা। সব জায়গায় সঞ্চিত সোনা বিক্রি করার হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, এবং অর্থনীতি একেবারে ধসে পড়তে শুরু করে।
এখানে দরিদ্র মানুষের অবস্থা, সত্যিই মনে দুঃখ দেবে আবার এটাও চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেবে আমরা সবসময় সেসমস্ত জিনিসের পেছনে ছুটি, যা সমাজের মতে মূল্যবান। বাকিদের মতামত যখন যে দিকে বাঁকবে, আমাদের সবার মতামত ও সেই দিকে ঝুঁকে পড়ে। আর শেষ পর্যন্ত ‘পরশ পাথর (Poroshpathor)’ ছবি আমাদের শিক্ষা দিয়ে যায় যে, আমরা সবসময় পার্থিব সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে ছুটে যাই, কিন্তু দিনের শেষে মনের শান্তিই আসল। মনে আনন্দ থাকলে বিলাসিতার প্রয়োজন হয় না। এই ভাবে ছোটো ছোটো বিষয় ‘পরশ পাথর (Poroshpathor) ’ কে অন্যতম বানিয়েছে, এবং এখন সত্যজিৎ রায়ের সেরা ছবি বানিয়েছে। আপনারা ইউটিউবে দেখতে পাবেন এই ‘পরশ পাথর (Poroshpathor) ’ সিনেমা।